দাঁতের মাড়ির রোগ (Gum Disease), যাকে চিকিৎসা ভাষায় বলা হয় পেরিয়োডোন্টাল ডিজিজ, এটি মাড়ির প্রদাহ এবং সংক্রমণজনিত একটি সমস্যা যা দাঁতের আশপাশের টিস্যুকে প্রভাবিত করে। এটি সাধারণত ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পায়। প্রধানত দুই ধরনের মাড়ির রোগ রয়েছে

১. জিঞ্জিভাইটিস (Gingivitis):

জিঞ্জিভাইটিসের প্রধান লক্ষণসমূহ:
জিঞ্জিভাইটিস (Gingivitis) হলো মাড়ির প্রদাহজনিত রোগের প্রাথমিক পর্যায়। এটি দাঁতের চারপাশের মাড়িকে প্রভাবিত করে এবং যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি পেরিওডোন্টাইটিস (Periodontitis) এর মতো গুরুতর মাড়ির রোগে রূপান্তরিত হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে জিঞ্জিভাইটিসের লক্ষণগুলো খুব সূক্ষ্ম হলেও সঠিকভাবে লক্ষ্য করলে শনাক্ত করা সম্ভব। নিচে জিঞ্জিভাইটিসের প্রধান লক্ষণসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
১. মাড়ি থেকে রক্তপাত (Bleeding Gums)
জিঞ্জিভাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রথম দিকের লক্ষণ হলো মাড়ি থেকে রক্ত পড়া।
- দাঁত ব্রাশ করার সময়, ফ্লস করার সময় অথবা শক্ত খাবার খাওয়ার সময় মাড়ি থেকে রক্ত বের হয়।
- রক্তপাত সাধারণত ব্যথাহীন হয়, যা অনেক সময় মানুষ উপেক্ষা করে।
- যদি নিয়মিত রক্তপাত হয়, তবে এটি জিঞ্জিভাইটিসের শক্ত ইঙ্গিত।
২. মাড়ির ফোলাভাব ও লালচে হওয়া (Swollen and Red Gums)
সুস্থ মাড়ি সাধারণত হালকা গোলাপি রঙের হয়। কিন্তু জিঞ্জিভাইটিস হলে মাড়ি লালচে, ফোলা এবং নরম হয়ে যায়।
- মাড়ি ফুলে যাওয়ায় দাঁতগুলো দেখতে ছোট লাগতে পারে।
- আঙুল দিয়ে হালকা চাপ দিলে মাড়িতে কোমলতা অনুভূত হয়।
৩. মাড়ির সংবেদনশীলতা ও ব্যথা (Tenderness or Discomfort in Gums)
জিঞ্জিভাইটিসের কারণে মাড়িতে হালকা ব্যথা বা জ্বালাভাব দেখা দেয়।
- বিশেষ করে ব্রাশ করার সময় বা খাবার চিবানোর সময় মাড়িতে ব্যথা লাগে।
- অনেক ক্ষেত্রে গরম বা ঠান্ডা খাবার খেলে অস্বস্তি বাড়ে।
৪. মুখে দুর্গন্ধ (Persistent Bad Breath / Halitosis)
জিঞ্জিভাইটিসে আক্রান্ত হলে মুখে স্থায়ী দুর্গন্ধ হয়।
- এর কারণ হলো দাঁত ও মাড়ির ফাঁকে জমে থাকা প্লাক এবং ব্যাকটেরিয়া।
- সাধারণ ব্রাশ বা মাউথওয়াশ দিয়ে এই দুর্গন্ধ পুরোপুরি দূর হয় না।
৫. মাড়ির রঙ পরিবর্তন (Change in Gum Color)
সুস্থ মাড়ি সাধারণত হালকা গোলাপি। কিন্তু জিঞ্জিভাইটিস হলে মাড়ির রঙ গাঢ় লাল, বেগুনি বা কখনও কালচে হতে পারে।
- এই রঙ পরিবর্তন প্রদাহের কারণে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধির ফল।
৬. দাঁতের চারপাশে প্লাক ও টার্টারের জমাট বাঁধা
জিঞ্জিভাইটিস মূলত দাঁতে জমে থাকা প্লাকের কারণে হয়।
- যদি দাঁত ও মাড়ির সংযোগস্থলে সাদা বা হলুদাভ আঠালো স্তর জমে থাকে, তবে তা প্লাক।
- দীর্ঘ সময় পরিষ্কার না করলে এটি টার্টার (ক্যালকুলাস) এ পরিণত হয়, যা জিঞ্জিভাইটিস বাড়িয়ে দেয়।
৭. মাড়ি চেপে ধরলে পুঁজ বা স্রাব হওয়া
প্রাথমিক পর্যায়ে জিঞ্জিভাইটিসে সাধারণত পুঁজ হয় না, তবে রোগ যদি অগ্রসর হয়, মাড়ি চেপে ধরলে সাদা বা হলুদাভ স্রাব বের হতে পারে।
- এটি সংক্রমণের লক্ষণ এবং তখনই চিকিৎসা প্রয়োজন।
৮. দাঁতের গলা উন্মুক্ত হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ
জিঞ্জিভাইটিস দীর্ঘদিন অবহেলা করলে মাড়ি ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করে।
- প্রাথমিকভাবে মাড়ি হালকা পিছু হটতে পারে, ফলে দাঁত কিছুটা লম্বা দেখাতে শুরু করে।
- এটি গুরুতর পেরিওডন্টাল রোগের দিকে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত।
৯. দাঁতের ফাঁকে অস্বস্তি অনুভব করা
জিঞ্জিভাইটিসের কারণে মাড়ি ফোলার ফলে দাঁতের ফাঁকে খাবার আটকে যেতে পারে।
- ফলে খাবার খাওয়ার সময় অস্বস্তি অনুভূত হয়।
১০. মুখে অদ্ভুত স্বাদ (Unpleasant Taste)
কিছু ক্ষেত্রে জিঞ্জিভাইটিসে আক্রান্ত হলে মুখে সব সময় তিক্ত বা ধাতব স্বাদ অনুভূত হতে পারে।
- এটি সাধারণত মাড়ি থেকে সামান্য রক্তপাতের কারণে হয়।
১১. ঠান্ডা বা গরম খাবারে সংবেদনশীলতা
জিঞ্জিভাইটিসের প্রভাবে দাঁতের আশেপাশের মাড়ি দুর্বল হয়ে গেলে ঠান্ডা বা গরম খাবারে দাঁত সংবেদনশীল হয়ে পড়তে পারে।
কীভাবে বুঝবেন যে এটি জিঞ্জিভাইটিস?
- দাঁত ব্রাশ করার সময় নিয়মিত রক্ত পড়ছে।
- মাড়ি লাল, ফোলা এবং সংবেদনশীল।
- মুখে দুর্গন্ধ আছে যা দূর হচ্ছে না।
- প্লাক বা টার্টার জমে গেছে।
জিঞ্জিভাইটিসের কারণের সংক্ষিপ্ত ধারণা
জিঞ্জিভাইটিসের প্রধান কারণ হলো দাঁতে জমে থাকা প্লাক। তবে ধূমপান, অনিয়মিত ব্রাশ, হরমোনাল পরিবর্তন, ডায়াবেটিস ইত্যাদিও এর ঝুঁকি বাড়ায়
কখন ডেন্টিস্টের কাছে যাবেন?
যদি আপনি নিচের লক্ষণগুলো লক্ষ্য করেন, দ্রুত ডেন্টিস্টের কাছে যান:
✔ নিয়মিত মাড়ি থেকে রক্ত পড়ছে
✔ মুখে দুর্গন্ধ দূর হচ্ছে না
✔ মাড়ি ফুলে আছে বা রঙ পরিবর্তন হয়েছে
✔ দাঁত নড়াচড়া করছে বা মাড়ি সরে যাচ্ছে
২. পেরিয়োডোন্টাইটিস (Periodontitis):
পেরিয়োডোন্টাইটিস (Periodontitis) হলো মাড়ির রোগের একটি গুরুতর এবং দীর্ঘমেয়াদী রূপ, যা জিঞ্জিভাইটিসের (প্রাথমিক মাড়ির প্রদাহ) অবহেলিত বা চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় পরিণত হয়। এটি দাঁতের আশপাশের টিস্যু এবং হাড় ধ্বংস করতে পারে, যার ফলে দাঁত নড়তে শুরু করে এবং একসময় পড়ে যেতে পারে।

পেরিয়োডোন্টাইটিসের লক্ষণসমূহ:
পেরিয়োডোন্টাইটিস (Periodontitis) হলো মাড়ির রোগের একটি গুরুতর পর্যায়, যা দাঁতের আশেপাশের টিস্যু এবং হাড়কে প্রভাবিত করে। সাধারণত এটি জিঞ্জিভাইটিসের (Gingivitis) পরবর্তী স্তরে গড়ায়, যখন মাড়ির প্রদাহ চিকিৎসাহীন থেকে যায়। এই রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দাঁত ধরে রাখা হাড় (Alveolar Bone) ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে, ফলে দাঁত নড়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত পড়ে যেতে পারে। তাই এর লক্ষণগুলো জানা অত্যন্ত জরুরি। নিচে পেরিয়োডোন্টাইটিসের প্রধান লক্ষণসমূহ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।
১. মাড়ি থেকে রক্তপাত (Bleeding Gums)
পেরিয়োডোন্টাইটিসে আক্রান্ত হলে মাড়ি থেকে নিয়মিত রক্তপাত হয়।
- দাঁত ব্রাশ করার সময় বা খাবার চিবানোর সময় রক্তপাত হতে পারে।
- কখনও কখনও ঘুম থেকে ওঠার পর মুখে রক্তের স্বাদ বা লালচে লালা দেখা যায়।
২. মাড়ির ফোলা ও রঙ পরিবর্তন
সুস্থ মাড়ি গোলাপি বা হালকা লাল রঙের হয়, কিন্তু পেরিয়োডোন্টাইটিস হলে মাড়ি গাঢ় লাল, বেগুনি বা বাদামি রঙের হতে পারে।
- মাড়ি ফোলা এবং নরম হয়ে যায়।
- আঙুল দিয়ে চাপ দিলে ব্যথা অনুভূত হয়।
৩. মুখে দুর্গন্ধ (Persistent Bad Breath / Halitosis)
পেরিয়োডোন্টাইটিসের অন্যতম লক্ষণ হলো মুখে স্থায়ী দুর্গন্ধ।
- ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ও পচা টিস্যুর কারণে দুর্গন্ধ হয়।
- সাধারণ ব্রাশ, ফ্লসিং বা মাউথওয়াশে এ দুর্গন্ধ দূর হয় না।
৪. মাড়ি সরে যাওয়া (Receding Gums)
পেরিয়োডোন্টাইটিসে মাড়ি ধীরে ধীরে পেছনে সরে যায়, ফলে দাঁতের গলা (Root) উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
- দাঁত লম্বা দেখাতে শুরু করে।
- মাড়ি সরে যাওয়ার কারণে দাঁতের ফাঁক বাড়ে।
৫. দাঁতের নড়াচড়া (Loose or Mobile Teeth)
যখন দাঁতের আশেপাশের হাড় ক্ষয় হতে থাকে, তখন দাঁত ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করে।
- খাবার চিবানোর সময় দাঁত নড়াচড়া অনুভূত হয়।
- রোগ গুরুতর হলে দাঁত নিজে থেকেই পড়ে যেতে পারে।
৬. দাঁতের অবস্থান পরিবর্তন (Teeth Shifting)
পেরিয়োডোন্টাইটিসের ফলে দাঁতের সাপোর্ট কমে যায়, ফলে দাঁতের পজিশন পরিবর্তন হয়।
- বিশেষ করে সামনের দাঁতগুলো ফাঁক হয়ে যেতে পারে।
- হঠাৎ করে দাঁতের সেটে পরিবর্তন লক্ষ্য করলে এটি একটি সতর্ক সংকেত।
৭. মাড়ি ও দাঁতের মাঝে গভীর পকেট তৈরি হওয়া (Periodontal Pockets)
- পেরিয়োডোন্টাইটিসে মাড়ি ও দাঁতের মাঝে গভীর ফাঁক তৈরি হয়, যাকে পেরিওডন্টাল পকেট বলা হয়।
- এই পকেটে খাবারের কণা, প্লাক ও পুঁজ জমে থাকে।
- পকেট যত গভীর, রোগ তত গুরুতর।
৮. মাড়ি থেকে পুঁজ বা স্রাব বের হওয়া
পেরিয়োডোন্টাইটিসের উন্নত পর্যায়ে মাড়ি থেকে সাদা বা হলুদাভ পুঁজ বের হতে পারে।
- মাড়ি চেপে ধরলে বা দাঁত চিবানোর সময় এই পুঁজ বের হয়।
- এটি গুরুতর সংক্রমণের ইঙ্গিত।
৯. খাবার চিবানোর সময় ব্যথা বা অস্বস্তি
দাঁতের সাপোর্টিং টিস্যু দুর্বল হয়ে যাওয়ায় খাবার চিবানোর সময় ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হয়।
- কখনও কখনও নরম খাবার চিবালেও ব্যথা হয়।
১০. দাঁতের সংবেদনশীলতা (Tooth Sensitivity)
মাড়ি সরে যাওয়া এবং দাঁতের রুট উন্মুক্ত হয়ে পড়ার কারণে দাঁত ঠান্ডা বা গরম খাবারে সংবেদনশীল হয়ে যায়।
- ঠান্ডা পানি পান করলে বা গরম চা খেলে ব্যথা বাড়ে।
১১. মুখে খারাপ স্বাদ (Unpleasant Taste)
- সংক্রমণের কারণে মুখে সব সময় খারাপ স্বাদ থাকে।
- পুঁজ ও রক্তের কারণে ধাতব বা তিক্ত স্বাদ অনুভূত হয়।
১২. দাঁতের ফাঁকে খাবার আটকে যাওয়া
পেরিয়োডোন্টাইটিসে দাঁতের ফাঁক বাড়ে এবং মাড়ি সরে যাওয়ার ফলে খাবার আটকে থাকে।
- এর ফলে দাঁতে প্লাক জমে এবং সংক্রমণ আরও বৃদ্ধি পায়।
১৩. মুখে শুষ্কতা (Dry Mouth)
যদিও এটি প্রধান লক্ষণ নয়, তবে পেরিয়োডোন্টাইটিসে আক্রান্ত অনেক রোগী মুখ শুকিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেন।
- বিশেষ করে যারা ধূমপান করেন বা ওষুধের কারণে লালা কম নিঃসৃত হয়, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি।
পেরিয়োডোন্টাইটিসের লক্ষণ বুঝে কী করবেন?
যদি দাঁতের নড়াচড়া, মাড়ি থেকে পুঁজ বা দাঁতের ফাঁক বাড়ার মতো লক্ষণ থাকে, অবিলম্বে ডেন্টিস্টের কাছে যান।
রুটিন ডেন্টাল চেকআপ করলে রোগটি প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা যায়।
চিকিৎসা না করলে এটি দাঁত হারানোর পাশাপাশি হাড় ক্ষয়ের কারণ হতে পারে।
দাঁতে মাড়ির রোগের কারণ/ (Causes of gum disease):
দাঁতের মাড়ির রোগের মূল কারণসমূহ:

দাঁতের মাড়ির রোগ বা Gum Disease (পেরিওডন্টাল ডিজিজ) হলো দাঁতের চারপাশের মাড়ি ও সাপোর্টিং টিস্যুর প্রদাহ বা সংক্রমণজনিত সমস্যা। এই রোগের মূল কারণ হলো ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ, তবে আরও নানা ফ্যাক্টর এর জন্য দায়ী। কারণগুলো বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মাড়ির রোগ প্রতিরোধের জন্য এর মূল উৎস চিহ্নিত করা জরুরি। নিচে বিস্তারিতভাবে মাড়ির রোগের প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো।
১. ডেন্টাল প্লাক (Dental Plaque)
মাড়ির রোগের সবচেয়ে বড় কারণ হলো দাঁতে জমে থাকা প্লাক।
- প্লাক হলো একটি নরম, আঠালো স্তর যা দাঁতের উপর গঠিত হয়।
- এটি মূলত ব্যাকটেরিয়া, খাবারের কণা ও লালা দিয়ে তৈরি।
- যদি ব্রাশিং এবং ফ্লসিং সঠিকভাবে না করা হয়, এই প্লাক শক্ত হয়ে টার্টার (Calculus) এ পরিণত হয়।
- এই ব্যাকটেরিয়া টক্সিন উৎপন্ন করে যা মাড়িতে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং জিঞ্জিভাইটিস (প্রাথমিক মাড়ির রোগ) তৈরি করে।
২. অনিয়মিত মুখগহ্বরের পরিচর্যা (Poor Oral Hygiene)
- দিনে দুইবার দাঁত ব্রাশ না করা বা ফ্লসিং না করলে প্লাক জমে যায়।
- মাউথওয়াশ ব্যবহার না করার ফলে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
- সঠিক ব্রাশিং টেকনিক না জানা বা নরম ব্রাশ ব্যবহার না করাও মাড়ির স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
৩. ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য (Smoking & Tobacco Use)
- ধূমপান মাড়ির রক্ত সঞ্চালন কমিয়ে দেয়, ফলে মাড়ি দুর্বল হয়।
- নিকোটিন ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বাড়িয়ে দেয়।
- সিগারেট, বিড়ি, পান, জর্দা ইত্যাদি মাড়ির রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
- ধূমপায়ীদের মধ্যে পেরিওডোন্টাল ডিজিজের হার অনেক বেশি।
৪. ডায়াবেটিস (Uncontrolled Diabetes)
- ডায়াবেটিস রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে মাড়ি সহজেই সংক্রমিত হয়।
- উচ্চ রক্তে শর্করার মাত্রা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বাড়ায়।
- ডায়াবেটিসের কারণে মাড়ি শুকিয়ে যায় এবং ইনফেকশন দ্রুত ছড়ায়।
৫. হরমোনের পরিবর্তন (Hormonal Changes)
- গর্ভাবস্থা, মাসিক চক্র, মেনোপজ বা পিউবার্টির সময় হরমোনের পরিবর্তন মাড়িকে সংবেদনশীল করে তোলে।
- গর্ভাবস্থায় অনেক নারীর Pregnancy Gingivitis হয়, যেখানে মাড়ি লাল, ফোলা ও রক্তপাতপ্রবণ হয়।
৬. পুষ্টির অভাব (Poor Nutrition)
- ভিটামিন C এর অভাব মাড়ির স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
- পর্যাপ্ত ভিটামিন ও মিনারেল না থাকলে মাড়ি দুর্বল হয়ে যায় এবং সহজে প্রদাহ হয়।
- জাঙ্ক ফুড ও অতিরিক্ত চিনি সমৃদ্ধ খাবার ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বাড়ায়।
৭. দাঁতের অপ্রতুল বিন্যাস (Misaligned Teeth)
- দাঁতের গেঁড়ো অবস্থান বা টেডমেড দাঁতের ফাঁকে খাবার জমে থাকে।
- ব্রাশ ও ফ্লসিং সঠিকভাবে না হওয়ায় প্লাক ও টার্টার তৈরি হয়।
- এর ফলে মাড়িতে প্রদাহ ও সংক্রমণ দেখা দেয়।
৮. অপর্যাপ্ত লালা নিঃসরণ (Dry Mouth / Xerostomia)
- লালা মুখ পরিষ্কার রাখে এবং ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
- যারা পর্যাপ্ত পানি পান করেন না বা নির্দিষ্ট ওষুধের কারণে লালা কম হয়, তাদের মাড়ির রোগের ঝুঁকি বেশি।
- বিশেষ করে কিছু ওষুধ যেমন অ্যান্টিহিস্টামিন, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ইত্যাদি মুখ শুকিয়ে দেয়।
৯. ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়া
- HIV/AIDS রোগী, ক্যান্সারের চিকিৎসাধীন ব্যক্তি বা যারা স্টেরয়েড ওষুধ গ্রহণ করছেন, তাদের মাড়ি সহজেই আক্রান্ত হয়।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে সংক্রমণ দ্রুত ছড়ায়।
১০. বংশগত কারণ (Genetic Factors)
- কিছু মানুষের জন্মগতভাবে মাড়ির রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে।
- পারিবারিক ইতিহাসে পেরিওডন্টাল ডিজিজ থাকলে ঝুঁকি বাড়ে।
১১. মানসিক চাপ (Stress)
- দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রেস ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দেয়।
- কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বাড়ার ফলে সংক্রমণ প্রতিরোধ কমে যায় এবং মাড়ি সংবেদনশীল হয়।
১২. অ্যালকোহল ও মাদক সেবন
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল মুখ শুকিয়ে দেয় এবং মুখের স্বাভাবিক ব্যাকটেরিয়া ভারসাম্য নষ্ট করে।
- ড্রাগ সেবনকারীদের মধ্যে মাড়ির রোগের হার অনেক বেশি।
১৩. সঠিক ডেন্টাল চেকআপ না করা
- নিয়মিত স্কেলিং না করালে দাঁতের পাথর (টার্টার) জমে যায়।
- দীর্ঘ সময় চেকআপ না করায় প্রাথমিক মাড়ির রোগ শনাক্ত করা যায় না।
কীভাবে প্রতিরোধ করবেন?
- দিনে অন্তত দুইবার ব্রাশ করুন এবং ফ্লসিং করুন।
- প্রতি ৬ মাসে একবার ডেন্টাল চেকআপ করুন।
- ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য পরিহার করুন।
- সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন, বিশেষ করে ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাবার।
- ডায়াবেটিস থাকলে নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
দাঁতে মাড়ির রোগের লক্ষণসমূহ:
দাঁতের মাড়ির রোগ (Gum Disease) সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকেই তা বুঝতে পারেন না। তবে কিছু লক্ষণ আছে যেগুলো সচেতনভাবে লক্ষ্য করলে সহজেই ধরা যায়।

দাঁতের মাড়ির রোগের সাধারণ লক্ষণসমূহ:
১. মাড়ি থেকে রক্ত পড়া (Bleeding Gums)
মাড়ির রোগের অন্যতম প্রথম এবং প্রধান লক্ষণ হলো দাঁত ব্রাশ করার সময় বা শক্ত খাবার খাওয়ার সময় মাড়ি থেকে রক্ত পড়া।
- প্রাথমিকভাবে এটি জিঞ্জিভাইটিস (Gingivitis) নামে পরিচিত, যেখানে মাড়িতে হালকা প্রদাহ হয়।
- মাড়ি নরম ও ফোলা থাকে, ফলে অল্প চাপেই রক্ত বের হয়।
উপেক্ষা করলে কি হয়? সময়মতো চিকিৎসা না করলে এই রক্তক্ষরণ পরবর্তীতে পেরিওডোন্টাইটিস (Periodontitis) এ রূপান্তরিত হতে পারে।
২. মাড়ির ফোলা ও লালচে হওয়া (Swollen and Red Gums)
সুস্থ মাড়ি সাধারণত গোলাপি বা হালকা লাল রঙের হয়। কিন্তু সংক্রমণের কারণে মাড়ি লাল, ফোলা ও সংবেদনশীল হয়ে যায়।
- ফোলাভাব সাধারণত প্রদাহের কারণে হয়।
- আঙুল দিয়ে চাপ দিলে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
৩. মুখে দুর্গন্ধ (Bad Breath / Halitosis)
মাড়ির রোগে আক্রান্ত হলে মুখে স্থায়ী দুর্গন্ধ হয়, যা সাধারণ ব্রাশ বা মাউথওয়াশ দিয়ে দূর হয় না।
- এর কারণ হলো দাঁত ও মাড়ির ফাঁকে জমে থাকা ব্যাকটেরিয়া।
- খাবারের কণা পচে গিয়ে দুর্গন্ধ বাড়িয়ে তোলে।
৪. দাঁতের ফাঁকে পুঁজ বা মাড়ি থেকে স্রাব হওয়া
গুরুতর মাড়ির রোগে মাড়ি থেকে পুঁজ বের হতে পারে।
- এটি মূলত সংক্রমণ ও টিস্যু ক্ষয়ের লক্ষণ।
- মাড়ি চেপে ধরলে সাদা বা হলুদাভ রঙের পুঁজ বের হতে পারে।
এটি গুরুতর সতর্ক সংকেত।
৫. দাঁতের চারপাশে পকেট তৈরি হওয়া (Gum Pockets)
যখন মাড়ি ও দাঁতের মধ্যে ফাঁক বাড়তে থাকে, তখন সেখানে ব্যাকটেরিয়া, খাবারের কণা ও প্লাক জমে গিয়ে পকেট তৈরি হয়।
- এই পকেট যত গভীর হয়, মাড়ির রোগ তত গুরুতর হয়।
- সাধারণত পেরিওডোন্টাল ডিজিজের উন্নত পর্যায়ে এটি দেখা যায়।
৬. দাঁত ঢিলা হয়ে যাওয়া (Loose Teeth)
প্রথম দিকে মাড়ির রোগ শুধু মাড়িকে প্রভাবিত করে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দাঁতের সহায়ক হাড় (Alveolar bone) ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- ফলে দাঁত ধীরে ধীরে ঢিলা হতে শুরু করে।
- দাঁত চিবানোর সময় অস্বাভাবিক নড়াচড়া অনুভূত হতে পারে।
এটি দাঁত হারানোর প্রধান কারণ।
৭. দাঁতের অবস্থান পরিবর্তন (Teeth Shifting)
মাড়ির রোগের কারণে হাড় ক্ষয় হলে দাঁত ধীরে ধীরে স্থান পরিবর্তন করে।
- বিশেষ করে সামনের দাঁতগুলো ফাঁক হয়ে যেতে পারে।
- হাসার সময় দাঁতের গ্যাপ বেশি চোখে পড়ে।
৮. চিবানোর সময় অস্বস্তি বা ব্যথা
মাড়ির প্রদাহ বা সংক্রমণের কারণে দাঁত ও মাড়ি দুর্বল হয়ে যায়।
- ফলে খাবার চিবানোর সময় ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- বিশেষ করে শক্ত বা কড়া খাবার খেতে গেলে অস্বস্তি বাড়ে।
৯. দাঁতের গলা উন্মুক্ত হওয়া (Receding Gums)
মাড়ির রোগে মাড়ি ধীরে ধীরে সরে যায় এবং দাঁতের গলা (Root portion) উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
- এতে দাঁত লম্বা দেখাতে শুরু করে।
- দাঁতের সংবেদনশীলতা (Sensitivity) বাড়ে।
১০. দাঁতের অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা (Tooth Sensitivity)
যখন মাড়ি সরে যায় এবং দাঁতের রুট উন্মুক্ত হয়, তখন ঠান্ডা-গরম খাবার খেলে দাঁতে ব্যথা লাগে।
- এটি সাধারণত উন্নত পর্যায়ের মাড়ির রোগের লক্ষণ।
১১. স্থায়ী ব্যথা বা অস্বস্তি
গুরুতর মাড়ির রোগে স্থায়ী ব্যথা, চাপ অনুভূতি বা ভারী লাগা দেখা যায়।
- কখনও কখনও ব্যথা কানের দিকে ছড়িয়ে যেতে পারে।
কারণ বুঝে নেওয়া জরুরি
উপরের লক্ষণগুলো সাধারণত তখন দেখা দেয় যখন দাঁতে প্লাক ও টার্টার (ক্যালকুলাস) জমে যায় এবং মাড়িতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে।
- ধূমপান, অনিয়মিত ব্রাশ, ডায়াবেটিস, হরমোন পরিবর্তন ইত্যাদি কারণেও মাড়ির রোগ হতে পারে।
কখন ডেন্টিস্টের কাছে যাবেন?
যদি আপনার নিম্নলিখিত লক্ষণগুলোর যেকোনো একটি থাকে, তবে দ্রুত ডেন্টিস্টের সাথে যোগাযোগ করা উচিত:
- মাড়ি থেকে নিয়মিত রক্ত পড়ছে
- মুখে স্থায়ী দুর্গন্ধ
- দাঁত নড়াচড়া শুরু করেছে
- মাড়ি সরে যাচ্ছে বা দাঁত লম্বা দেখাচ্ছে
দাঁতে মাড়ির রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ:
দাঁতের মাড়ির রোগ (Gum Disease) প্রতিকারযোগ্য যদি তা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা যায় এবং সঠিকভাবে যত্ন নেওয়া হয়। পাশাপাশি, কিছু সহজ নিয়ম মেনে চললে এ রোগ সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।
দাঁতের মাড়ির রোগের প্রতিকার
১. নিয়মিত স্কেলিং (Professional Cleaning)
- ডেন্টিস্টের মাধ্যমে দাঁতের গোড়া থেকে প্লাক ও টারটার অপসারণ করা হয়।
- প্রাথমিক পর্যায়ের জিঞ্জিভাইটিসের জন্য এটি যথেষ্ট।
২. রুট প্ল্যানিং (Root Planing)
- দাঁতের শিকড় মসৃণ করে দেওয়া হয় যেন ব্যাকটেরিয়া সহজে জমতে না পারে।
- মাড়ির নিচে পরিষ্কার করার জন্য এটি প্রয়োজন হয় পেরিয়োডোন্টাইটিসে।
৩. অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি
- মুখে খাওয়ার অথবা মাড়িতে প্রয়োগযোগ্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে।
৪. সার্জারি (গুরুতর ক্ষেত্রে)
- যেমন ফ্ল্যাপ সার্জারি, বোন গ্রাফট বা গাইডেড টিস্যু রিজেনারেশন।
- ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু ও হাড় পুনর্গঠনে সহায়তা করে।
দাঁতের মাড়ির রোগ প্রতিরোধে করণীয়:
১. সঠিকভাবে ও নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করুন
- দিনে অন্তত ২ বার (সকাল ও রাতে)
- নরম ব্রাশ ও ফ্লুরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করুন
২. ফ্লস করুন প্রতিদিন
- দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা খাবার ও ব্যাকটেরিয়া দূর করতে
৩. মাউথওয়াশ ব্যবহার করুন
- জীবাণুনাশক মাউথওয়াশ ব্যবহার করলে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ কমে
৪. ধূমপান ত্যাগ করুন
- ধূমপান মাড়ির রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত করে এবং রোগ প্রতিরোধ কমায়
৫. পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করুন
- ভিটামিন C ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার মাড়ি ও দাঁত সুস্থ রাখতে সাহায্য করে
৬. নিয়মিত ডেন্টাল চেক-আপ নিন
- অন্তত ৬ মাসে একবার ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া
৭. ক্রনিক রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন
- যেমন: ডায়াবেটিস, যা মাড়ির রোগের ঝুঁকি বাড়ায়
মাড়ির রোগ প্রতিরোধে নিয়মিত পরিচর্যা করাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
উপসংহার:
দাঁতের মাড়ির রোগ (গাম ডিজিজ) মুখের স্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা, যা উপেক্ষা করলে দাঁত হারানো পর্যন্ত পরিস্থিতি পৌঁছাতে পারে। সাধারণত প্লাক ও টার্টার জমে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে মাড়ি ফুলে যায়, রক্ত পড়ে এবং ধীরে ধীরে হাড় ক্ষয় হতে থাকে। প্রথমদিকে গিংজিভাইটিস হিসেবে শুরু হলেও চিকিৎসা না করালে তা পেরিওডন্টাইটিসে রূপ নেয়, যা অনেক বেশি ক্ষতিকর। এই রোগ শুধু দাঁতের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে না, বরং শরীরের অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, যেমন হৃদরোগ বা ডায়াবেটিসের জটিলতা।
তবে সুখবর হলো, সময়মতো যত্ন নিলে মাড়ির রোগ প্রতিরোধযোগ্য। প্রতিদিন সঠিকভাবে ব্রাশ ও ফ্লস করা, নিয়মিত ডেন্টাল চেকআপ করানো, এবং পেশাদার স্কেলিং ও পলিশিং করানো এ রোগ প্রতিরোধে কার্যকর। এছাড়া ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য পরিহার করা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অতএব, মাড়ির রোগকে অবহেলা না করে প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। দাঁত ও মাড়ি সুস্থ থাকলে কেবল আপনার হাসি নয়, সার্বিক শারীরিক স্বাস্থ্যও সুরক্ষিত থাকবে। নিয়মিত ডেন্টাল কেয়ারই হলো মাড়ির রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি।