দাঁতে মাড়ির রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

দাঁতের মাড়ির রোগ (Gum Disease), যাকে চিকিৎসা ভাষায় বলা হয় পেরিয়োডোন্টাল ডিজিজ, এটি মাড়ির প্রদাহ এবং সংক্রমণজনিত একটি সমস্যা যা দাঁতের আশপাশের টিস্যুকে প্রভাবিত করে। এটি সাধারণত ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পায়। প্রধানত দুই ধরনের মাড়ির রোগ রয়েছে

HRTD Dental Services 4

Table of Contents

১. জিঞ্জিভাইটিস (Gingivitis):

জিঞ্জিভাইটিসের প্রধান লক্ষণসমূহ:

  • মাড়ি লালচে বা গাঢ় লাল হয়ে যাওয়া
  • ব্রাশ বা ফ্লস করার সময় সহজে রক্ত পড়ে যাওয়া
  • মাড়িতে ফুলে যাওয়া বা নরম অনুভব
  • মুখে দুর্গন্ধ (Bad breath)
  • দাঁতের চারপাশে মাড়ি টানটান না থাকা
কারণসমূহ:
  • দাঁতে জমে থাকা প্লাক (এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও খাবারের অবশিষ্টাংশ)
  • দাঁতের সঠিক পরিচর্যার অভাব
  • ধূমপান
  • হরমোনজনিত পরিবর্তন (গর্ভাবস্থা, কিশোর বয়স)
  • কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
  • ডায়াবেটিস বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
চিকিৎসা ও প্রতিকার:
  1. প্রতিদিন সঠিকভাবে দাঁত ব্রাশ করা (২ বার)
  2. ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করা – দাঁতের ফাঁকে থাকা প্লাক দূর করতে
  3. মাউথওয়াশ ব্যবহার – জীবাণুনাশক গার্গল (যেমন ক্লোরহেক্সিডিন)
  4. ডেন্টাল স্কেলিং – ডেন্টিস্টের মাধ্যমে দাঁতের প্লাক ও টারটার পরিষ্কার করা
  5. ধূমপান বন্ধ করা
  6. স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ – ভিটামিন C এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার মাড়িকে সুস্থ রাখে

২. পেরিয়োডোন্টাইটিস (Periodontitis):

পেরিয়োডোন্টাইটিস (Periodontitis) হলো মাড়ির রোগের একটি গুরুতর এবং দীর্ঘমেয়াদী রূপ, যা জিঞ্জিভাইটিসের (প্রাথমিক মাড়ির প্রদাহ) অবহেলিত বা চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় পরিণত হয়। এটি দাঁতের আশপাশের টিস্যু এবং হাড় ধ্বংস করতে পারে, যার ফলে দাঁত নড়তে শুরু করে এবং একসময় পড়ে যেতে পারে।

পেরিয়োডোন্টাইটিসের লক্ষণসমূহ:

  • মাড়ি পেছিয়ে যাওয়া (receding gums)
  • দাঁতের চারপাশে গভীর ফাঁক তৈরি হওয়া (periodontal pockets)
  • দাঁত নড়তে থাকা বা জায়গা বদলানো
  • মাড়ি থেকে রক্ত পড়া ও ব্যথা
  • চিবানোর সময় অস্বস্তি
  • মুখে দুর্গন্ধ বা খারাপ স্বাদ
  • মাড়ি থেকে পুঁজ পড়া (severe cases)

কারণসমূহ:

  • জিঞ্জিভাইটিসের অবহেলা
  • প্লাক ও টারটার জমে থাকা – যা দাঁতের গোড়ায় ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটায়
  • ধূমপান – রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়
  • ডায়াবেটিস
  • অপর্যাপ্ত ও অনিয়মিত ওরাল হাইজিন
  • পারিবারিক ইতিহাস বা জেনেটিক ঝুঁকি

চিকিৎসা পদ্ধতি:

১. স্কেলিং ও রুট প্ল্যানিং (Deep Cleaning):

প্লাক এবং টারটার দাঁতের গোড়া থেকে সরিয়ে ফেলা হয় এবং রুটের পৃষ্ঠ মসৃণ করে ব্যাকটেরিয়ার বাড়বাড়ি ঠেকানো হয়।

২. অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি:

ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণে মুখে খাওয়ার বা সরাসরি মাড়িতে প্রয়োগযোগ্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়।

৩. সার্জারি (প্রয়োজনে):
  • ফ্ল্যাপ সার্জারি: মাড়ি খুলে গভীরভাবে টিস্যু পরিষ্কার করা হয়
  • বোন গ্রাফট / টিস্যু গ্রাফট: হাড় বা টিস্যুর ক্ষয় পুনর্গঠনের জন্য
  • গাইডেড টিস্যু রিজেনারেশন: নতুন হাড় ও টিস্যু বৃদ্ধির সহায়তা করা হয়

প্রতিরোধে যা করবেন:

  • প্রতিদিন ২ বার দাঁত ব্রাশ করুন (সঠিক কৌশলে)
  • প্রতিদিন ফ্লস ব্যবহার করুন
  • নিয়মিত ডেন্টাল চেক-আপ নিন (৬ মাস পরপর)
  • ধূমপান বর্জন করুন
  • সুস্থ জীবনযাপন এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন

দাঁতে মাড়ির রোগের কারণ/ (Causes of gum disease):

দাঁতের মাড়ির রোগের মূল কারণসমূহ:

১. প্লাক (Plaque) জমা হওয়া

  • দাঁতে প্রতিদিন জমে যাওয়া খাবারের কণা ও ব্যাকটেরিয়ার স্তর
  • এটি ঠিকভাবে পরিষ্কার না করলে মাড়িতে প্রদাহ সৃষ্টি করে

২. টারটার (Tartar বা Calculus)

  • প্লাক কঠিন হয়ে গেলে এটি টারটারে পরিণত হয়
  • টারটার দাঁতের গোড়ায় মাড়ির নিচে গিয়েও ইনফেকশন ছড়ায়

৩. দাঁতের সঠিক যত্ন না নেওয়া

  • নিয়মিত ব্রাশ ও ফ্লস না করা
  • ভুল পদ্ধতিতে ব্রাশ করা

৪. ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য

  • মাড়ির রক্ত চলাচল ব্যাহত করে
  • সংক্রমণের প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়

৫. হরমোন পরিবর্তন

  • গর্ভাবস্থা, মাসিক চক্র, মেনোপজ ইত্যাদির সময় মাড়ি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে

৬. ডায়াবেটিস

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে

৭. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

  • কিছু ওষুধ মাড়ি শুকিয়ে দেয় বা ফুলিয়ে তোলে (যেমন: ব্লাড প্রেসার, হৃদরোগ ও ডিপ্রেশনের ওষুধ)

৮. মানসিক চাপ

  • স্ট্রেস রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল করে, যা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে বাধা দেয়

 ৯. পুষ্টির ঘাটতি

  • বিশেষ করে ভিটামিন C-এর অভাব মাড়ি দুর্বল করে তোলে

১০. জেনেটিক বা বংশগত ঝুঁকি

  • পরিবারের কারও যদি পেরিয়োডোন্টাল সমস্যা থাকে, তবে ঝুঁকি বাড়ে

প্রতিরোধে করণীয়:

  • প্রতিদিন নিয়ম করে সঠিক পদ্ধতিতে দাঁত ব্রাশ ও ফ্লস করুন
  • ৬ মাস অন্তর দাঁতের ডাক্তার দেখান
  • ধূমপান ত্যাগ করুন
  • পুষ্টিকর খাবার খান
  • স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে রাখুন

দাঁতে মাড়ির রোগের লক্ষণসমূহ:

দাঁতের মাড়ির রোগ (Gum Disease) সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকেই তা বুঝতে পারেন না। তবে কিছু লক্ষণ আছে যেগুলো সচেতনভাবে লক্ষ্য করলে সহজেই ধরা যায়।

দাঁতের মাড়ির রোগের সাধারণ লক্ষণসমূহ:

১. মাড়ি থেকে রক্ত পড়া
  • ব্রাশ বা ফ্লস করার সময় মাড়ি থেকে রক্ত ঝরা রোগের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষণ।
২. মাড়ি ফুলে যাওয়া ও লাল হয়ে যাওয়া
  • স্বাস্থ্যবান মাড়ি গোলাপি ও শক্ত হয়, কিন্তু রোগাক্রান্ত মাড়ি লালচে ও ফোলা থাকে।
৩. মাড়িতে ব্যথা বা স্পর্শকাতরতা
  • চিবানোর সময় বা ব্রাশ করলে মাড়িতে অস্বস্তি বা ব্যথা অনুভূত হয়।
৪. মুখে দুর্গন্ধ (Bad Breath)
  • দীর্ঘস্থায়ী মুখের দুর্গন্ধ যা মাউথওয়াশেও যাচ্ছে না।
৫. মাড়ি সঙ্কুচিত হয়ে দাঁতের গোড়া উন্মুক্ত হওয়া (Gum Recession)
  • মাড়ি দাঁত থেকে সরে গেলে দাঁতের শিকড় দেখা যায় এবং সংবেদনশীলতা বাড়ে।
৬. দাঁত নড়তে থাকা বা অবস্থান পরিবর্তন
  • দাঁত ঢিলা হয়ে যাওয়া বা আগের চেয়ে জায়গা বদলে যাওয়া গুরুতর রোগের ইঙ্গিত।
৭. মাড়ির ফাঁকে পুঁজ (Pus) বের হওয়া
  • এটি সংক্রমণের গুরুতর লক্ষণ এবং তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা প্রয়োজন।
৮. চিবানোর সময় অস্বস্তি
  • ব্যথা বা চাপ অনুভব হতে পারে, যা দাঁতের ভিত্তি দুর্বল হওয়ার ইঙ্গিত।

দাঁতে মাড়ির রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ:

দাঁতের মাড়ির রোগ (Gum Disease) প্রতিকারযোগ্য যদি তা প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা যায় এবং সঠিকভাবে যত্ন নেওয়া হয়। পাশাপাশি, কিছু সহজ নিয়ম মেনে চললে এ রোগ সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।

দাঁতের মাড়ির রোগের প্রতিকার

১. নিয়মিত স্কেলিং (Professional Cleaning)
  • ডেন্টিস্টের মাধ্যমে দাঁতের গোড়া থেকে প্লাক ও টারটার অপসারণ করা হয়।
  • প্রাথমিক পর্যায়ের জিঞ্জিভাইটিসের জন্য এটি যথেষ্ট।
২. রুট প্ল্যানিং (Root Planing)
  • দাঁতের শিকড় মসৃণ করে দেওয়া হয় যেন ব্যাকটেরিয়া সহজে জমতে না পারে।
  • মাড়ির নিচে পরিষ্কার করার জন্য এটি প্রয়োজন হয় পেরিয়োডোন্টাইটিসে।
৩. অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি
  • মুখে খাওয়ার অথবা মাড়িতে প্রয়োগযোগ্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে।
৪. সার্জারি (গুরুতর ক্ষেত্রে)
  • যেমন ফ্ল্যাপ সার্জারি, বোন গ্রাফট বা গাইডেড টিস্যু রিজেনারেশন।
  • ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু ও হাড় পুনর্গঠনে সহায়তা করে।

দাঁতের মাড়ির রোগ প্রতিরোধে করণীয়:

১. সঠিকভাবে ও নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করুন

  • দিনে অন্তত ২ বার (সকাল ও রাতে)
  • নরম ব্রাশ ও ফ্লুরাইডযুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করুন
২. ফ্লস করুন প্রতিদিন
  • দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা খাবার ও ব্যাকটেরিয়া দূর করতে
৩. মাউথওয়াশ ব্যবহার করুন
  • জীবাণুনাশক মাউথওয়াশ ব্যবহার করলে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ কমে
৪. ধূমপান ত্যাগ করুন
  • ধূমপান মাড়ির রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত করে এবং রোগ প্রতিরোধ কমায়
৫. পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করুন
  • ভিটামিন C ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার মাড়ি ও দাঁত সুস্থ রাখতে সাহায্য করে
৬. নিয়মিত ডেন্টাল চেক-আপ নিন
  • অন্তত ৬ মাসে একবার ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া
৭. ক্রনিক রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন
  • যেমন: ডায়াবেটিস, যা মাড়ির রোগের ঝুঁকি বাড়ায়

মাড়ির রোগ প্রতিরোধে নিয়মিত পরিচর্যা করাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top